• রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৫৬ পূর্বাহ্ন
  • [gtranslate]
Headline
বিটিএসএফ কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো ঈদ পূর্ণমিলনী অনুষ্ঠান। পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত বৈষম্য এবং পাহাড় নিয়ে দেশি-বিদেশিদের ষড়যন্ত্র অবগত করে স্মারকলিপি প্রদান করেন: পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ। চট্টগ্রামে শিশুটির লাশ দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা পর নিজ বাসার পাশেই ভেসে উঠলো কয়রায় এক যুগ আগের হত্যা মামলায় ৬ সাংবাদিকসহ ১১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা সাংবাদিকের প্রাণনাশের হুমকির প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে দুই ভূয়া ডি বি পুলিশ আটক পাহাড়ি শিক্ষার্থীর(চবি) মুক্তিতে এখন কেন সেনাবাহিনীর দরকার? চট্টগ্রামে আত্মীয়ার বাসায় বেড়াতে এসেই যেন কাল হলো শিশুটির মায়ের পার্বত্য চুক্তি বিচ্ছিন্নতাবাদী এলিট শ্রেণী চাকমার স্বার্থ রক্ষার ব্যতিরেকে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে অকেজো। দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে আগুনে পুড়ে ছাই ৬ বসত ঘর, নারীসহ দগ্ধ ৩

স্বজাতি সন্ত্রাসের ছায়ায় পাহাড়ি জনজীবন: আত্মপরিচয়ের সংকটে সাধারণ পাহাড়ি জনগণ”

Reporter Name / ৭৪ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অনন্য সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল। বহু বছর ধরে এখানে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, লুসাই, ম্রো সহ বহু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয় নিয়ে। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে রাষ্ট্রীয় একতরফা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী কে সুবিধা, অন্যদের অবহেলা, উন্নয়ন বৈষম্য, ও রাষ্টীয় অধিকার সংকটের কারণে এই অঞ্চলটি পরিণত হয়েছে এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত-নির্ভর ভূখণ্ডে।

দুঃখজনকভাবে, আজ শুধু বাঙ্গালিরা নয়—সাধারণ পাহাড়িরাও পাহাড়ি সন্ত্রাসীর কাছে নিরাপদ নন। যে ভূমিতে স্বজাতি ছিল আশ্রয় ও আত্মীয়তার প্রতীক, সেই ভূমিতেই এখন পাহাড়ি জনগণ নিজেদের স্বজাতি সন্ত্রাসীদের হাতেই আক্রান্ত ও অপমানিত। প্রতিনিয়ত হত্যা,গুম, অপহরণসহ হেনেস্থার শিকার হচ্ছেন। সুতরাং সাধারণ পাহাড়িরা নিজেদের স্বজাতি সন্ত্রাসীদের কাছেও নিরাপদ নন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও জাতিসত্তার লড়াই-
স্বাধীনতার পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের মাঝে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের দাবিতে সৃষ্টি হয় একটি সংগঠিত সশস্ত্র রাজনৈতিক চেতনা। সেই চেতনা থেকে জন্ম নেয় “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (JSS)” এবং তার সশস্ত্র শাখা “শান্তিবাহিনী”। তাদের মূল দাবি ছিল—আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, পূর্ণ ভূমির অধিকার, ও জাতিগত পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি।
১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে JSS-এর স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি মিথ্যা আশার আলো দেখিয়ে সাধারণ পাহাড়িদের নিয়ে জনমত গড়ে তুলতেন সরকারের বিপক্ষে, একতরফা চাকমা গোষ্ঠীর প্রাপ্ত সুবিধা, অন্য জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে বাস্তবায়নে গড়িমসি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং পাহাড়িদের মাঝে মতাদর্শগত বিভাজন নতুন করে সংকট ডেকে আনে। ফলে জন্ম নেয় বিভিন্ন প্রতিযোগী গোষ্ঠী, যেমন—UPDF, জেএসএস সংস্কার, এবং পরবর্তী সময়ে আরও অনেক বিচ্ছিন্ন উপদল। এই বিভাজনের ফলে যে সহিংসতা ও অনিরাপত্তা শুরু হয়, তা কেবল রাষ্ট্র/বাঙ্গালি বনাম পাহাড়ি জনগণের নয়, বরং পাহাড়ি বনাম পাহাড়ির মধ্যেও।

স্বজাতি গোষ্ঠীর মধ্যেই সহিংসতা: আতঙ্কের প্রতিদিন-
১. প্রতিযোগিতামূলক আধিপত্য বিস্তার বর্তমানে বিভিন্ন পাহাড়ি গোষ্ঠী নিজেদের “আদর্শিক পবিত্রতা” ও “জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি” হিসেবে দাবি করে। এর ফলে গড়ে উঠেছে এক ধরনের ছায়া-শাসন ব্যবস্থা। এসব গোষ্ঠী স্থানীয় জনগণের উপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে—
চাঁদা আদায় করে,
কৃষকদের ফসল থেকে অংশ নেয়,
বিভিন্ন মোবাইল সিম কোম্পানি, মেডিসিন কোম্পানি, সরকারি-বেসরকারি ত্রাণসামগ্রী, সকল পরিবহন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতসহ একটি নির্দিষ্ট চাঁদা দিতে হয় সাধারণ পাহাড়ি-বাঙ্গালিদের।
স্কুল, হাসপাতাল বা এনজিওদের ওপর প্রভাব খাটায়।
যে কোনো সাধারণ পাহাড়ি যদি নিরপেক্ষ থাকতে চায়, বা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ রাখে, তবে তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে দমন করা হয়। গুম, খুন, বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, এমনকি দলত্যাগী আত্মীয়দের উপর হামলার ঘটনাও অহরহ।

২. আত্মীয়তার বন্ধনে ভয়
একই গ্রামে বসবাসরত দুই পাহাড়ি পরিবার, যারা একসময় উৎসব ভাগ করে নিতো, আজ পরস্পরের প্রতি সন্দিহান। কোনো পরিবারের সদস্য যদি জেএসএস-এর প্রতি অনুগত হয়, আর অন্যজন ইউপিডিএফ-এর, তাহলে তাদের সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। ‘স্বজাতি’ শব্দটি এখানে এক আত্মিক বন্ধন নয়, বরং একটি সম্ভাব্য হুমকি।

৩. নারীদের অস্তিত্ব সংকট
নারীরা সবচেয়ে বেশি অসহায়। ‘দলীয় অনুগামী’ নারীকে সম্মান দেওয়া হলেও, বিপক্ষ ভাবা হলে নানা ধরনের সামাজিক-মানসিক নিপীড়নের শিকার হতে হয়। এমনকি কিছু অঞ্চলে জোরপূর্বক বিয়ের অভিযোগও পাওয়া যায়। নারীদের উপর এই নির্যাতন পাহাড়ি সমাজের মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরও ক্ষতি করছে।

রাষ্ট্র ও প্রশাসনের ভূমিকায় প্রশ্নচিহ্ন-
যদিও পার্বত্য চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল—সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা ভূমি কমিশনের সক্রিয়তা, এবং স্থানীয় প্রশাসনে পাহাড়িদের ক্ষমতায়ন; বাস্তবে তার খুব বেশিটাই কার্যকর হয়েছে। পাহাড়ে ‘গণতন্ত্র’ এখন অস্ত্রধারীদের হাতে বন্দী, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও একধরনের দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। অনেক সময় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সাধারণ পাহাড়িরাও এইসব পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সাধারণ পাহাড়িরা কখনোই প্রত্যাশা করেন না সেনাবাহিনী কে পাহাড় থেকে প্রত্যাহার কারার। বরং সাধারণ পাহাড়িরা সকল জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তার স্বার্থে প্রত্যাহারকৃত দুইশত চুয়াল্লিশ টি সেনাক্যাম্প পুন:স্থাপন চান।

সমাধানের পথ: সহিংসতা নয়, সংলাপ ও সংবেদনশীলতা
এই সংকটের সমাধান কেবল এটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবিক সমাধানেই উচিত বলে মনেকরি। কিছু সম্তাব্য প্রস্তাবনা নিচে তুলে ধরা হলো:

পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্পসহ আরো একাধিক নতুন সেনানিবাস নির্মাণ করা।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমে জিরো টলারেন্স
সাধারণ পাহাড়িদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ বেসামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করা।
সকল জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে ভূমি কমিশনের কার্যকরীকরণ ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা
সকল জাতিগোষ্ঠীর নারী ও তরুণদের অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্বে আনয়ন।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে পাহাড়ে মানবাধিকার পরিস্থিতির নিরীক্ষণ করা।
উন্মুক্ত প্রবেশ বন্ধ, অরক্ষিত সীমান্তকে নিরাপদ রাখা।
সকল জাতিগোষ্ঠীকে সংবিধান মানাতে বাধ্য করা।
নির্বাচিত প্রতিনিধি তৈরি করা। যেমন- জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য উন্নয়ন বোড, শরণার্থী টাস্কফোর্স বোড ইত্যাদি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ আর কেবল একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়—এটি একটি সঙ্কটবহুল মনস্তত্ত্বের নাম, যেখানে “স্বজাতি” শব্দটি আশ্রয় নয়, বরং আশঙ্কার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সাধারণ পাহাড়িদের জীবনে প্রতিদিনের প্রশ্ন—“আমি কাকে বিশ্বাস করব?” এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
শান্তি ও সহাবস্থানের জন্য চাই, পাহাড়ি-বাঙ্গালির সমাজে আভ্যন্তরীণ সহিংসতার অবসান এবং রাষ্ট্রের দৃঢ় অথচ মানবিক ভূমিকা। নয়তো পাহাড়ের মাটি শুধু রক্তেই ভিজে যাবে, জাতিগোষ্ঠীর(পাহাড়ি-বাঙ্গালি) কোন্দল, স্বজাতি লড়াই শুধু সহিংসতার কাব্যে রূপ নেবে।

লেখক: ওমর ফারুক
সহ-সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক কেন্দ্রীয় কমিটি,
সাবেক- সিনিয়র সদস্য, চবি শাখা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ(পিসিসিপি)।
[email protected]

Facebook Comments Box


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
bdit.com.bd