বিশেষ প্রতিনিধি:
বাংলা নববর্ষ, বাংলাদেশের অন্যতম সর্বজনীন ও ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবে পরিচিত। এই উৎসবের প্রাক্কালে রাজধানী ঢাকা হয়ে ওঠে নানা রঙের, সংস্কৃতির ও দাবির সম্মিলনস্থল। তবে ১৪৩২ বঙ্গাব্দের নববর্ষে একটি ব্যতিক্রমী ও গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য চোখে পড়ে—বিভিন্ন উগ্রবাদী উপজাতি গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি মিছিল, যেখানে তারা “সেনাবাহিনী হটাও”, “আদিবাসী স্বায়ত্তশাসন চাই” ইত্যাদি স্লোগান দিচ্ছিলেন। সাধারণ নববর্ষের আনন্দের আবহে এই মিছিল ছিল ব্যতিক্রমী, রাজনৈতিক এবং সুস্পষ্ট বাঙ্গালির ঐতিহ্যবাহী পহেলা বৈশাখ কে নৎসাত করার বার্তা। এই ঘটনাটি শুধু একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি নয়, বরং বাংলাদেশের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও দেশ ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিফলন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা-
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সতেরো শতকে বসবাস শুরু করেন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রোসহ প্রায় ১৩টিরও বেশি উপজাতি গোষ্ঠীরক। বিভিন্ন গবেষণামূলক তথ্যমতে, তাদের আদি নিবাস ভরত, বর্মা(মায়ানমার), চম্পকনগর, তিব্বতীয়, নেপাল, কম্বোডিয়াসহ প্রভৃতি জায়গাতে। স্বাধীনতা পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পার্বত্য চট্টগ্রাম সন্ত্রাসী উপজাতি জনগোষ্ঠীর সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্রমেই জটিল হয়ে ওঠে। কারণ সশস্ত্র উপজাতি সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশের সংবিধানকে মনেপ্রাণে অস্বীকৃতি জানান। তারা চান পূর্ণস্বায়ত্তশাসন। সেই জন্যে ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনী ও সরকার নিয়ন্ত্রণ কে প্রতিহত করতে সশস্ত্র শান্তি বাহিনী (Shanti Bahini) গঠিত করেন এবং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র উপজাতি সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল বর্তমানেও চলমান। এতে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি সেনা সদস্য ও কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত উপজাতি পরিচয়ে পার্বত্য চুক্তি- (Chittagong Hill Tracts Peace Accord) এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে চুক্তি হয়েছিল। তবে সেই চাকমা কেন্দ্রিক চুক্তির বেশিরভাগ ধারাই বাস্তবায়ন হয়েছে উপজাতিদের স্বার্থে। তারপরও সশস্ত্র উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তথাকথিত 'আদিবাসী' বাংলাদেশের সংবিধানে স্থাপনে অপকৌশল অব্যাহত রয়েছে। হঠাৎ ২০০৭ সালের পর থেকে আদিবাসী পরিচয়ে উতলা হয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক সুবিধার লালসে। তবে এই লালসার একাধিক সুবিধার অন্যতম উদ্দেশ্য দেশবিচ্ছিন্ন জুমল্যান্ড করা।
‘সেনাবাহিনী হটাও’ স্লোগানের তাৎপর্য-
নববর্ষে দেওয়া “সেনাবাহিনী হটাও” স্লোগানটি মূলত পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধেই একটি প্রতিবাদ। উপজাতিরা সর্বদাই মিথ্যাচার করেন, এই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি, ভূমি দখল। অথচ সেনাবাহিনীর মানবিক সাহায্য ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য হতো না। উপজাতিদের শিক্ষার হার ৭৭%, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙ্গালির শিক্ষার হার ২৩% । আজ সন্ত্রাসী উপজাতিরা সাধারণ পাহাড়িদের ভুল-ভ্রান্তি বুঝিয়ে রাষ্টের প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে। সেনাবাহিনী কর্তৃক উন্নয়নমুখী পার্বত্য চট্টগ্রামকে বারবার বাধাগ্রস্থ করেছেন সন্ত্রাসী উপজাতি সংগঠনগুলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সাধারণ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমতা ও সন্ত্রাসী উপজাতির নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার বিকল্প নেই সেনাবাহিনী ছাড়া।
রাজধানীতে মিছিলের কৌশলগত গুরুত্ব-
ঢাকা, দেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র।সেখানে মিছিল করার অর্থ, এই বার্তাগুলো শুধু স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করা। নববর্ষের মতো জনসমাগমপূর্ণ সময়ে এই মিছিল আয়োজন করা, একটি কৌশলগত আন্দোলন যা গণমাধ্যম ও নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সম্ভাব্য সহানুভূতি অর্জন। যাতে আন্তর্জাতিক মহলকে দেখাতে পারে বাংলাদেশের উপজাতিরা বৈষম্যের শিকার! কিন্তু তা অসত্য। মিথ্যাচার প্রচার-প্রচারণার জন্য এমনটি করেছেন।
রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গি-
বাংলাদেশ সরকার সাধারণত পার্বত্য চুক্তিকে বাস্তবায়নের দুইশত চুয়াল্লিশটি সেনা ক্যাম্প তুলে দেওয়ার পরও সীমান্ত পার্বত্য জেলাগুলোতে শান্ত থাকেনি বরং পার্বত্য অঞ্চলকে বিচ্ছেদ করার জন্য আরো নতুন কতগুলো সন্ত্রাসী দল-উপদল, উপজাতি নারীদের সমন্বয়ে উইমেন্স হিল ফেডারেশন নামে একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী রয়েছে। সেনাবাহিনীর ২৪৪ টি ক্যাম্প প্রত্যাহার নিয়ে সরকার প্রতিশ্রুতি পালন করাতে, অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে অবৈধ অস্ত্র, মাদক দ্রব্য, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপকর্ম দিন দিন বাড়ছে। এখন পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ জননিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। নাগরিক সমাজের একাংশ মনে করেন দেশের জনগনের মধ্যে এই ইস্যুটি নিয়ে সচেতনতা এখনও কম। তাই স্বার্ভৌমত্ব রাক্ষার্থে পার্বত্য সীমান্ত জেলার উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর রাষ্টবিরোধী কার্যক্রম নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কর্তব্য।
নববর্ষের মতো সাংস্কৃতিক উৎসবে উপজাতিরা রাজনৈতিক মিছিল আয়োজন নিছক একটি প্রতিবাদ নয়, বরং তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধবাদ করা। তথাকথিত আদিবাসী নাকি আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের প্রতীক? “সেনাবাহিনী হটাও” স্লোগান যেন একটি সমষ্টিগত যন্ত্রণা, যেটি শুধু পাহাড়ে নয়, সমতলেও বাংলাদেশের মাটি থেকে পার্বত্য কে পৃথক করার ষড়যন্ত্রকারী।
এই রাষ্টবিরোধী আন্দোলনে অংশীদার ও দায়িত্বশীলের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন বাম সংগঠন। এই সকল বাম সংগঠনের অনুপ্রেরণার জন্যে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, জেএসএস, ইউপিডিএফ, কুকিরা রাষ্টবিরোধী কর্মকাণ্ড করতে সাহস পান। আইনের বাস্তবিক প্রয়োগ, সমাধান ছাড়া পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি আসবে না। বরং তা আরও অসন্তোষ জন্ম দিতে পারে, যা রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের জন্যই হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: ওমর ফারুক
সহ-সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক কেন্দ্রীয় কমিটি
সাবেক সিনিয়র সদস্য, চবি শাখা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ(পিসিসিপি)।